বাংলাদেশে এবারের রোজার আগেই ইফতারিতে অন্যতম জনপ্রিয় আইটেম খেজুরের শুল্ক কমানো হয়েছে এবং পরে দামও বেঁধে দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরও খেজুরের বাজারকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না কর্তৃপক্ষ।
বৃহস্পতিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) খেজুরের আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করার পরও বাজারে যখন খেজুরের দাম বেড়েই চলছিল, তখন পরিস্থিতি সামলাতে রোজা শুরুর আগের দিন বহুল ব্যবহৃত দুই ধরনের খেজুরের দাম বেঁধে দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
ব্যবসায়ীরা বলছেন আগে যেখানে শুল্ক ছিল না সেখানে অতি মাত্রায় শুল্ক আরোপ করতে গিয়েই আন্তর্জাতিক বাজারে খেজুরের দাম কম থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের বাজারে খেজুরের দাম কয়েকগুণ বেড়ে গেছে।
তাদের দাবি বাজারের সবচেয়ে কম দামি খেজুরেও প্রতি কেজিতে ৫২ টাকা কর নিচ্ছে সরকার, ফলে অন্য সব খরচ মিলিয়ে এক শ’ টাকার খেজুর হয়ে যাচ্ছে আড়াই শ’ টাকা।
বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটুও বলেন, ‘আগে ট্যাক্স-ফ্রি থাকলেও এবার ডলার বাইরে চলে যাওয়াসহ নানা কারণে এনবিআর শুল্ক আরোপ করেছে।’
তিনি বলেন, ‘আমদানি মূল্য, ডলারের দাম এবং ট্যাক্স তিনটি মিলেই খেজুরের দাম এ অবস্থায় গেছে। আমরা মানুষকে স্বস্তি দিতে বেশি ব্যবহৃত হয় এমন দুই ধরনের খেজুরের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছি।’
যদিও অভিযোগ আছে, কোনো কোনো আমদানিকারক খেজুর এনেও পর্যাপ্ত পরিমাণে বাজারে ছাড়ছেন না। তবে, ব্যবসায়ীরা এসব অভিযোগ মানতে রাজি নন।
দাম এত বেশি কেন :
অভিযোগ উঠেছে যে অতি মাত্রায় শুল্কের পাশাপাশি রমজানে অতিরিক্ত চাহিদাকে পুঁজি করে ব্যবসায়ীদের অতি লাভের প্রবণতার কারণেই এবার খেজুরের দাম হু হু করে বেড়েছে।
ব্যবসায়ীরা অবশ্য বলছেন, ‘অতি মাত্রায় শুল্ক নির্ধারণের কারণেই বাংলাদেশের বাজারে খেজুরের এত দাম।’
বছরের শুরু থেকেই বাজারে খেজুরের দাম বাড়তে থাকলে এ নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়। এরপর গত মাসের শুরুতে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে শুল্ক কমানোর নির্দেশনা পায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর। এর আগে খেজুরের ওপর খুব একটা শুল্ক ছিল না।
ব্যবসায়ীরা বলেন, ‘২০২২ সালে এসে আমদানি নিয়ন্ত্রণের জন্য শুল্ক আরোপ করে সরকার।’
এতে আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ, মূসক/ভ্যাট ১৫ শতাংশ, ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর, ৫ শতাংশ অগ্রিম কর এবং তিন শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপ করে সরকার।
বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইম্পোটার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘তাদের এক হাজার ডলারের খেজুরের জন্য এখন চার হাজার ডলার ট্যারিফ ভ্যালু দিতে হচ্ছে। পাশাপাশি বেড়েছে সংশ্লিষ্ট অন্য খরচগুলোও।’
ইসলাম বলেন, ‘ফলে এক শ’ টাকা দামের খেজুর এমনি চার শ’ টাকা হয়ে যাচ্ছে। এর সাথে পরিবহন ও বিপণন খরচসহ অন্য খরচ আছে। ৯০ টাকার ডলার এখন ১২২ টাকা। এসবই দাম আকাশচুম্বী হওয়ার কারণ।’
রোজার এক মাস আগেই দাম বৃদ্ধির এমন পরিস্থিতি দেখে শুল্ক কমানোর নির্দেশনা পায় এনবিআর। এরপর গত ৮ ফেব্রুয়ারি ১০ শতাংশ শুল্ক কমায় এনবিআর।
শুল্ক কমানোর পর রোববার (১০ মার্চ) পর্যন্ত এক মাসে দেশে খেজুর আমদানি হয়েছে ৩৮ হাজার টনের সামান্য বেশি।
ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এর অর্ধেকই হলো বস্তায় করে আনা খেজুর। আর এর এক চতুর্থাংশ হলো জাইদি খেজুর।
সিরাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, মূলত, এ দু’ধরনের খেজুরই বাংলাদেশে বেশি আমদানি হয়। কিন্তু রোজার আগে এসব খেজুরের দাম বাড়তে থাকলে ১১ মার্চ প্রজ্ঞাপন দিয়ে সাধারণ মানের খেজুর ১৫০ থেকে ১৬৫ টাকা এবং জাইদি খেজুর ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা নির্ধারণ করে দেয় সরকার।
ভোক্তাদের অভিযোগ, যদিও বাজারে এ দামে খেজুর পাওয়া যায় না। বরং খবর পাওয়া যাচ্ছে কিছু কিছু বাজারে এসব খেজুরই ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা বিক্রির।
ইসলাম বলেন, ‘আগে এসব মাঝারি মানের খেজুর ৮০ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি করতে পারতাম আমরা। এবার ১০০ টাকার খেজুরে শুল্কই হলো দেড় শ’ টাকা।’
চট্টগ্রামের খেজুর আমদানিকারক ফারুক ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের কর্ণধার ফারুক আহমেদ বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে কিন্তু দাম কম। বাংলাদেশে আসলেই অতি মাত্রায় শুল্ক দেয়ার কারণে কয়েকগুণ দাম হয়ে যাচ্ছে।’
তার দাবি, খেজুর আমদানির সাথে সংশ্লিষ্ট পিপি ব্যাগ, ড্রাই কন্টেইনার, হিমায়িত কন্টেইনার সব কিছুতে শুল্ক ৩/৪ শ’ গুণ বাড়ানো হয়েছে। রিটেইল প্যাকেটজাত কার্টন ছিল ২২ টাকার সামান্য কম। সেটি এখন ১৮০ টাকা।
খেজুর আসে কোথা থেকে?
বাংলাদেশে খেজুর আসে মূলত ইরাক, সংযুক্ত আরব আমিরাত, তিউনিসিয়া ও আলজেরিয়া থেকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত জাইদি খেজুর আমদানি করা হয় ইরাক থেকে। এছাড়া সৌদি আরব, মিশরসহ আরো কিছু দেশ থেকে অল্প পরিমাণে খেজুর আসে এ দেশের বাজারে।
বাংলাদেশের বাজারে দামি খেজুর অল্প বিক্রি হলেও সেগুলো আমদানি মূল্যের কয়েকগুণ দামে বিক্রির অভিযোগ আছে।
সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশে খেজুর আসার পরিমাণ খুব একটা বেশি নয়।’
তার কথায়, ‘সাধারণত উচ্চমূল্যের খেজুরগুলো সেখান থেকে আসে। সহজলভ্য খেজুরের জন্য আমাদের পছন্দ ইরাক। বিশেষ করে ব্যবসায়ীরা দাম কম হওয়ায় জাইদি খেজুর সেখান থেকেই আনেন।’
দেশের বাজারে ২০ থেকে ২৫ ধরনের খেজুর পাওয়া যায়। এর মধ্যে বস্তায় করে আসা খোলা খেজুর যেমন ২০০ থেকে ৩০০ টাকা কেজিতে পাওয়া যায়, তেমনি আবার উচ্চমূল্যের খেজুরের মধ্যে আজওয়ার কেজি ২০০০ টাকার বেশি। যদিও এসব খেজুরের কেজি প্রতি আমদানি মূল্য ৫০০ টাকার মধ্যেই।
কর ও পরিবহন খরচ মিলে এর খুচরা মূল্য ৮০০ থেকে ৯০০ টাকার মধ্যে হওয়ায় কথা থাকলেও বাজারে কেন এটি দ্বিগুণেরও বেশি দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের, তার কোনো জবাব পাওয়া যায় না।
এছাড়া দামি খেজুরের মধ্যে মরিয়ম ও মেডজুল বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত ক্রেতাদের কাছে কিছুটা জনপ্রিয়। তবে গত এক মাসে এ ধরনের খেজুর এসেছে আড়াই শ’ টনেরও কম।
বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেন, ‘এনবিআর শুল্কের জন্য কয়েকটা স্ল্যাব করে দিয়েছে। এখন ব্যবসায়ীরা যেই দামেই আমদানি করুক না কেন এই কয়েকটি স্ল্যাবের মধ্যে ফেলে শুল্ক নেয়া হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘এখানেই ব্যবসায়ীদের আপত্তি। আমরা ব্যবসায় কোনো হস্তক্ষেপ করছি না। তবে জনজীবনে স্বস্তি আনতে যৌক্তিক দাম নির্ধারণে উৎসাহিত করছি। সেজন্যই দু’ধরনের খেজুরের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে।’
জানা গেছে, মূলত, প্যাকেটজাত, কার্টন, বস্তায় ভরা শুকনো ও ভেজা-এই চার ক্যাটাগরিতে রেখে খেজুরের শুল্ক নির্ধারণ করা হয়।
আরব ও মুসলিম দেশগুলোতে খেজুর জনপ্রিয় :
আরব বিশ্ব এবং এর বাইরে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দেশগুলোতে রোজার সময় খেজুরের চাহিদা বেশ বেড়ে যায়। বিশ্বের ১০০-রও বেশি দেশে খেজুর রফতানি করে সৌদি আরব। আবার সেখানে উৎপাদিত খেজুরের প্রায় অর্ধেক খেজুর ব্যবহার হয় রমজান মাসেই। তবে সাধারণ মানুষ বেশি ক্রয় করেন জাইদি খেজুর, যার বড় রফতানিকারক দেশ হলো ইরাক।
এর বাইরে আলজেরিয়া ও তিউনিসিয়া থেকে বাংলাদেশ, পাকিস্তান কিংবা এ ধরনের দেশগুলোতে বেশি খেজুর আমদানি হয়। তবে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, উচ্চমূল্যের খেজুরের জন্য সৌদি আরবসহ অল্প কয়েকটি আরব দেশ সুপরিচিত।
সূত্র : বিবিসি
https://slotbet.online/