ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট-২০২৪ অনুযায়ী, সুখী দেশের তালিকায় ১১ ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। তা সুখ নিয়ে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এবং বিশ্লেষকদের ভাবনা কী?
সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে, সুখ একেক জনের কাছে একেকরকম। সুখের অনুভূতিও আলাদা।
ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট-২০২৪ বলছে, বিশ্বের ১৪৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদের এখন অবস্থান ১২৯। ২০২৩ সালে বাংলদেশের অবস্থান ছিল ১১৮। এবারের সুখ সূচকে বাংলাদেশের পাশের দেশগুলোর মধ্যে নেপাল ৯৩, পাস্তিান ১০৮, মিয়ানমার ১১৮, ভারত ১২৬ ও শ্রীলঙ্কা ১২৮ এবং আফগানিস্তান ১৪৩তম অবস্থানে।
আফগানিস্তান একেবারে তলানিতে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার অন্য সবদেশের তুলনায় বাংলাদেশে সুখ কম। অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির মতো দেশেও সুখ কমেছে। ওই দুটি দেশ সুখী দেশের শীর্ষ কুড়িতেও নেই। তবে টানা সপ্তমবারের মতো বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশ হয়েছে ফিনল্যান্ড।
জাতিসঙ্ঘের উদ্যোগে সুখী দেশের তালিকা করার ক্ষেত্রে মানুষের সুখের নিজস্ব মূল্যায়ন, সেই সাথে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে শূন্য থেকে ১০ সূচকে নম্বর পরিমাপ করা হয়। পাশাপাশি প্রতিটি দেশের মানুষের ব্যক্তিগত সুস্থতার অনুভূতি, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, উদারতা, জিডিপি ও দুর্নীতির মাত্রা বিবেচনায় নেয়া হয়।
কলাবাগানের রিকশাচালক বিল্লাল মিয়া ৬৩ বছর বয়সেও রিকশা চালাচ্ছেন। তারপরও তিনি নিজেকে সুখী ভাবেন। তার কথা,‘স্ত্রী ছেলে-মেয়ে নিয়ে খেয়ে পরে বেঁচে আছি এটাই আমার সুখ। আগে আমি একা কাজ করতাম, এখন আমার ছেলেও করে। আমার পরিবারে আয় এখন আগের চেয়ে বেশি।’ তবে তার কষ্ট আছে। আয় বেশি হলেও ব্যয়ও বেড়ে গেছে। এছাড়া চারদিকের দুর্নীতিও তাকে কষ্ট দেয়।
পাসপোর্ট অফিসে কাজ করেন সোহাগ মিয়া। তার কথা,‘এখন আর আগের মতো আয় নাই। অনেক কিছুই অনলাইনে হওয়ায় আগের মতো লোকজন আর আসে না। নিজেরাই কাজ করে।’ আর দোকানদার মিন্টু মিয়ার কথা,‘সারাদিন জিনিসপত্রের দাম নিয়ে মানুষের সাথে ঝগড়া করতে হয়। শান্তি নাই। আয় কমে গেছে। দাম বাড়লেও তা আমরা পাই না। আরো আছে নানা উৎপাত। পুলিশের চাঁদা, এলাকার পাতি নেতার চাপ।’
বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া অনুপ দাস পিয়ালের কথা,‘সামনেই মাস্টার্স পরীক্ষা। এরপর কী করবো তাই ভাবছি। এতদিন চিন্তা ছিল না। ভালোই ছিলাম। কিন্তু এখন মাথায় চাকরির চিন্তা ঢুকেছে।’
মিরপুরের বেসরকারি চাকরিজীবী জেসমিন লিপি বলেন,‘করোনার পর থেকে বেসরকারি চাকরির অবস্থা খারাপ। বেতন বাড়ে না। সরকারি চাকরিতে তো বেতন বাড়ে। সরকার তাদের দেখে। কিন্তু আমাদের কেউ দেখে না।’
নানা কারণে পারিবারিক জীবনেও বাড়ছে অশান্তি। অনেকের সাথে কথা বলে মনে হয়েছে জিনিসপত্রের দামই বাংলাদেশের মানুষকে এখন সবচেয়ে বেশি চাপে রেখেছে। তার প্রভাব পড়ছে সবখানে। এর সাথে রাজনীতি, বাকস্বাধীনতা এইসব বিষয় নিয়েও ভাবেন অনেকে।
জিডিপি বৃদ্ধি ও সুখ
সিরডাপের পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মো: হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘পেটে ভাত না থাকলে কোনোভাবেই সুখ আসবে না। আমাদের মাথাপিছু যে আয় বাড়ছে এটা গড় হিসাব। আসলে সবার বাড়ছে না, কিছু লোকের বাড়ছে। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির ফলে সাধারণ মানুষ তো ভালো নেই। সে ভোগ কমাতে বাধ্য হচ্ছে। ভোগ কমলে সুখও কমবে।’
সমাজ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নেহাল করিমের মতে সুখ একেক জনের কাছে একেকরকম। সুখের অনুভূতিও আলাদা। কেউ দিয়ে সুখী আর কেউ পেয়ে সুখী। কিন্তু এর মধ্যে একটি স্বাধীনতার বিষয় আছে বলে মনে করেন এই সমাজবিজ্ঞানী। তার কথা,‘আমার কী আছে বা নেই সেটা তো আমার প্রকাশের স্বাধীনতা থাকতে হবে। আমার বলার সুযোগ থাকতে হবে।’
‘সমাজে, রাষ্ট্রে নানা অস্থিরতা। রাজনীতির সঙ্কট, ন্যায় বিচারের সঙ্কটসহ আরো সঙ্কট এখন। এটা নিয়ে কতজন মানুষ সুখে থাকতে পারে? কেউ হয়তো সুখে আছে। কেউ কেউ তো অন্যের সম্পদ কেড়ে নিয়েও সুখ পায়। ওই সুখের কথা আলাদা।’
কেন এত পিছিয়ে বাংলাদেশ?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ তানভীর রহমান বাংলাদেশের সেন্টমার্টিনের অধিবাসীদের নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি দেখেছেন সেখানকার মানুষজন নিজেদের সুখী মনে করেন। বছরে চার মাস কাজ করে তারা সারা বছর ভালো থাকার চেষ্টা করেন। তার মতে,‘তাদের মধ্যে কাজ করে আত্মবিশ্বাস আর ধর্ম বিশ্বাস। তারা আবার সংগ্রামী। বিপদে পড়লে শুধু ঘুরে দাঁড়ায় না, আরো বেশি শক্তি নিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়।’
তার মতে,‘বাংলাদেশে শহরের মানুষের চেয়ে গ্রামের মানুষের জীবন এখনো সরল। জীবন যত জটিল হয়, সঙ্কট যত বাড়ে, সুখ তত কমে।’ তিনি মনে করেন, বাংলাদেশ অর্থনীতি, সমাজ এবং প্রযুক্তির একটা ট্রানজিশন হচ্ছে। মানুষের মধ্যে নানা মানসিক দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে। যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে যাচ্ছে, চাপ নিতে হচ্ছে এককভাবে। ফলে সুখের মাত্রাও কমছে।
তিনি উদাহারণ দিয়ে বলেন,‘একজন রিকশাচালক সারাদিন কাজ করেন। অবসরে মোবাইলে তিনি পরীমনি , জায়েদ খানকে দেখেন। ফেসবুকে মানুষের বাহারি পোশাক, খাবার, জীবনযাপন দেখেন। সে তখন দেখে তার নাই। তখন আর তার সুখ থাকে না।’
বাংলাদেশে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় অর্থনীতি এগোচ্ছে দ্রুত। তবে এই দ্রুত অগ্রগতির কারণে যে বৈষম্য হয় তা দুর হচ্ছে না। এখানে সুখ কমছে। তবে এক সময় এই পরিবর্তন যখন স্থিতি অবস্থায় যাবে, তখন আবার সুখ ফিরে আসতে শুরু করবে বলে মনে করেন অধ্যাপক সৈয়দ তানভীর রহমান।
তার কথা,‘পৃথিবীতে এখন সুখ নিয়ে অনেক গবেষণা হচ্ছে। বাংলাদেশেও হচ্ছে। সুখের অভাব যত হবে, গবেষণাও তত বাড়বে।’
একটা বিষয় হলো মানুষের চাহিদা অনুযায়ী না পাওয়া বা না থাকা। সেটা মানুষকে অসুখী করতে পারে। আবার অর্থ সম্পদ বা তার ভোগের পণ্য থাকার পরও সুখ না থাকেতে পারে। আসলে সুখ আপেক্ষিক এবং এর সাথে নিরাপত্তা, স্বাধীনাতা, পরিবেশ, স্বাস্থ্য অনেক বিষয় নির্ভর করে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ এভাবেই চিন্তা করেন। তিনি অসুখী মানুষদের নিয়ে কাজ করেন, পরামর্শ দেন। তার কথা,‘বাংলদেশে সব দিকে একটি অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। সকালে বাজারে গিয়ে মেজাজ খারাপ হয়, রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম, নিরাপত্তার সঙ্কট। সব মিলিয়ে কোনো স্বস্তি পায় না মানুষ। তারপরে রাজনীতি, বাকস্বাধীনতা নিয়ে যে সংকট তা-ও তো অস্বীকার করা যাবে না।’
এই অবস্থা শুধু যে বাংলাদেশে তা তিনি মনে করেন না। করোনা, ইউক্রেন যুদ্ধ সারা বিশ্বেই একটি নতুন পরিস্থিতির তৈরি করেছে। বিশেষ করে করোনা মানুষের মনোজগতে একটা বড় প্রভাব ফেলেছে।
তার কথা,‘মানুষের প্রাপ্তির বিষয়টি জটিল। একজন ভালো আছেন, খেতে পারছেন, সম্পদ আছে, কিন্তু তিনি তার মনের কথা বলতে পারছেন না। তার বাকস্বাধীনতা নেই। ফলে অর্থ থাকার পরও তিনি অসুখী হতে পারেন। অর্থ থাকার পরও স্বাস্থ্যসেবা নাই বা নানা রোগে আক্রান্ত এটাও তাকে অসুখী করতে পারে।’
সূত্র : ডয়েচে ভেলে
https://slotbet.online/