ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির পরিবারের ভেতরে দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা এক বিবাদ প্রকাশ্যে এসে পড়েছে। তার ছোট ভাই স্বপন ব্যানার্জি, যাকে মানুষ বাবুন ব্যানার্জি বলেই চেনেন, তার সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছেন মমতা ব্যানার্জি।
ঘটনার সূত্রপাত তৃণমূল কংগ্রেস লোকসভা নির্বাচনে তাদের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করার পরেই।
মমতা ব্যানার্জির ভাই স্বপন, ওরফে বাবুন ব্যানার্জি ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন যে তিনি হাওড়া লোকসভা কেন্দ্র থেকে প্রার্থী হতে চান।
ওই কেন্দ্রে যাকে প্রার্থী করেছে তৃণমূল কংগ্রেস, গত দশ বছরের সংসদ সদস্য, সাবেক ফুটবলার প্রসূন ব্যানার্জি যে তার ঘোর অপছন্দের, সে কথাও বলেছিলেন মমতা ব্যানার্জির ছোট ভাই।
ঘটনাচক্রে পশ্চিমবঙ্গের একাধিক ক্রীড়া সংস্থার শীর্ষে রয়েছেন মমতা ব্যানার্জির এই ছোট ভাই। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে বেঙ্গল অলিম্পিকস অ্যাসোসিয়েশন, রাজ্য হকি এবং বক্সিং সংস্থা।
‘দিদি’ মমতা ব্যানার্জির ‘আশীর্বাদ’ নিয়ে তিনি হাওড়ায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন, এরকমও বলেছিলেন বাবুন ব্যানার্জি।
ওই কথা ঘোষণার পরে তিনি দিল্লি চলে গিয়েছিলেন। বাবুন ব্যানার্জি বিজেপিতে যোগ দিতে পারেন, এরকম খবরও চাউর হয়ে গিয়েছিল।
এর পরেই মমতা ব্যানার্জিকে সংবাদ সম্মেলনে বিষয়টি নিয়ে জানতে চাওয়া হয়।
‘সব সম্পর্ক ছিন্ন করলাম’
মমতা ব্যানার্জি এবং তার পরিবারকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে চেনেন, এরকম অন্তত দুজন সিনিয়র সাংবাদিক বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, সব থেকে ছোট ভাই স্বপন, ওরফে বাবুন ব্যানার্জীর সাথে মুখ্যমন্ত্রীর সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরেই খারাপ।
একবার এই ছোট ভাইয়ের সাথে অশান্তির কারণে মমতা ব্যানার্জি তার মাকে নিয়ে বাড়ি ছেড়েও চলে গিয়েছিলেন। সাময়িকভাবে তৃণমূল কংগ্রেসের দফতরে থাকতে শুরু করেছিলেন তিনি।
পরে অবশ্য বাড়ি ফিরে আসেন, তবে ভাই আর দিদির সম্পর্ক জোড়া লাগেনি কখনোই।
মাঝে মাঝে নিজের পরিবার এবং ছোট ভাইয়ের ব্যাপারে কিছু কথা বললেও শিলিগুড়ির সংবাদ সম্মেলনে বুধবার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী যতটা আবেগতাড়িত হয়ে কথা বলেছেন, সেরকমটা আগে কখনো ঘটেনি, এমনই বলছেন সিনিয়র সাংবাদিকরা।
মমতা ব্যানার্জি ছোট ভাইয়ের সম্পর্কে বলেন, ‘অনেক কষ্ট করে ছোট ভাই-বোনদের মানুষ করেছি আমি। কিন্তু ওকে মানুষ করতে পারিনি।’
‘আমার পরিবারে ৩২ জন সদস্য আছেন। সবাই ওর উপর ক্ষুব্ধ, প্রত্যেকবার ভোটের সময় অশান্তি করে। বড় হলে অনেকের লোভ বেড়ে যায়।’
‘আজ থেকে আমি শুধু নয়, মা মাটি মানুষের সাথে ওর সম্পর্ক বিচ্ছেদ হয়ে গেল। ভাই বলে পরিচয় দেবেন না। নো রিলেশন, সব সম্পর্ক ছিন্ন করলাম।’
তিনি এ-ও বলেছেন, ‘ও ভুলে গেছে বাবা মারা যাওয়ার পরে কিভাবে ওকে বড় করেছি আমি। মাত্র আড়াই বছর বয়স ছিল তখন ওর। আমি ৪৫ টাকা মাইনে পেয়ে ওদের বড় করেছি।’
ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা মমতা ব্যানার্জি প্রকাশ্যে ঘোষণা দেয়ার পরই বুধবার রাতে দিল্লি থেকে ফিরে এসেছেন স্বপন ওরফে বাবুন ব্যানার্জি।
সংবাদ মাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘দিদি আমার ভগবান। দিদি-ভাইয়ের ব্যাপার, দিদি আজকে বকল। কাল দিদিকে যতই হোক, আমি পায়ে ধরে নেব। দিদি যদি আমায় মারে-ধরে, এটা পরিবারের ব্যাপার।’
পরিবারতন্ত্রের অভিযোগ
প্রধানমন্ত্রীসহ বিজেপি নেতারা বারে বারেই বিরোধী দলগুলোতে পরিবারতন্ত্র চলছে বলে মন্তব্য করে থাকেন।
তাদের নিশানায় যে কয়েকটি রাজনৈতিক পরিবার থাকে, তার মধ্যে যেমন কংগ্রেসের গান্ধী পরিবার রয়েছে, তেমনই আছে মমতা ব্যানার্জির পরিবারের নামও।
ঘটনাচক্রে মমতা ব্যানার্জির পরিবারে তার ভাইপো অভিষেক ব্যানার্জি রাজনীতিতে এসেছেন আর তার পরিবারের আরেক সদস্য কাজরী ব্যানার্জি কয়েক বছর আগে কলকাতা পৌর সংস্থার নির্বাচনে নেমে কাউন্সিলর হয়েছেন।
মমতা ব্যানার্জিকে তার রাজনৈতিক জীবনের প্রায় শুরু থেকে দেখছেন, এমন এক সিনিয়র সাংবাদিক রন্তিদেব সেনগুপ্ত বলছিলেন, ‘মমতা একেবারেই সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’
‘তিনি যদি বাবুনের দাবি মেনে নিতেন, তাহলে তো পরিবারের আরো অনেক সদস্যও বিধায়ক, সংসদ সদস্য বা কাউন্সিলর হওয়ার দাবি জানাতে পারতেন। ভাইয়ের অভিমানকে পাত্তা না দিয়ে তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে একদম ঠিক কাজ করেছেন। বিজেপি তার বিরুদ্ধে পরিবারতন্ত্রের যে অভিযোগ করে, তার জবাব দিয়েছেন তিনি।’
রন্তিদেব সেনগুপ্ত বলেন, খুব কম বয়সে বাবাকে হারানোর পরে খুবই কষ্ট করে ভাই-বোনেদের বড় করেছেন মমতা ব্যানার্জি।
একটা সময় সরকারি দুধের দোকানে অস্থায়ী কাজ করতেন তিনি।
‘ভাই বোনেদের মমতা খুবই স্নেহ করেন। তাই হয়তো এর আগে প্রকাশ্যে কিছু বলতে পারেননি ছোট ভাইয়ের ব্যাপারে। তবে একটা সময়ের পরে তো ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। শেষমেশ তিনিও তো মানুষ।’
‘কেউ অন্যায্য চাপ তৈরি করবে, সেটা হয়তো তিনি আর সহ্য করতে পারছিলেন না,’ বলেন রন্তিদেব সেনগুপ্ত।
‘দলই আমার পরিবার’
মমতা ব্যানার্জি সব সময়েই বলে থাকেন যে দলই তার পরিবার। বুধবারের সংবাদ সম্মেলনেও সে কথা উল্লেখ করেন তিনি।
‘কিন্তু নিজের রক্তের সম্পর্কের যে পরিবার, এবং পরিবারতন্ত্র নিয়ে তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ ওঠে, তার এত বিস্তারিত জবাব মমতা ব্যানার্জিকে আগে দিতে দেখিনি,’ বলেন সিনিয়র সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরী।
তিনিও অনেক দশক ধরে মমতা ব্যানার্জির রাজনীতি খুব কাছ থেকে লক্ষ্য করে আসছেন।
‘একজন দক্ষ রাজনীতিবিদ হিসেবে সম্ভবত তিনি বুঝতে পারছিলেন যে বিজেপি তার বিরুদ্ধে যে পরিবারতন্ত্রের অভিযোগ তোলে, সেটা হয়তো মানুষ ভালোভাবে নিচ্ছে না।’
‘তাই তাকে একটা দীর্ঘ ব্যাখ্যা দিতে হয়েছে যে তিনি রক্তের সম্পর্কের পরিবারের সদস্যদের বাড়তি সুবিধা দেন না, পরিবারতন্ত্রে বিশ্বাস করেন না। বাবুন ব্যানার্জির এই ঘটনাটি একটা অনুঘটকের কাজ করেছে এখানে,’ বলেন জয়ন্ত চৌধুরী।
তবে অভিষেক ব্যানার্জির রাজনৈতিক কেরিয়ার শুরু করার জন্য মমতা ব্যানার্জি যে পৃথক একটি সংগঠন গড়ে দিয়েছিলেন, সেটাও উল্লেখ করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, তৃণমূল কংগ্রেসর গঠনতন্ত্রে যেসব শাখা সংগঠনের উল্লেখ আছে, তার মধ্যে ‘তৃণমূল যুবা’ বলে কোনো সংগঠনের কথা নেই।
কিন্তু ভাইপো অভিষেক ব্যানার্জিকে রাজনীতিতে নিয়ে আসার জন্য মমতা ব্যানার্জি ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পরে কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড ময়দানের জনসভায় ওই সংগঠনটির সূচনা করেছিলেন। শীর্ষে ছিলেন অভিষেক ব্যানার্জি।
পরে তৃণমূল কংগ্রেসের যুব শাখার সাথে মিশে যায় ‘তৃণমূল যুবা’ নামের সংগঠনটি।
ততদিনে অবশ্য রাজনীতিবিদ হিসেবে অভিষেক ব্যানার্জি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছেন।
সিনিয়র সাংবাদিক রন্তিদেব সেনগুপ্ত বলেন, ‘এটা ঠিকই যে মমতার হাত ধরেই অভিষেকের রাজনীতিতে আসা। সেই প্রথম নিজের পরিবারের কোনো সদস্যকে রাজনীতিতে নিয়ে এসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী।’
‘কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে সংসদ সদস্য হওয়ার পরে কিন্তু অভিষেক ব্যানার্জি নিজের দক্ষতা প্রমাণ করেছেন।’
‘এখন পুরোদস্তুর রাজনীতিবিদ হয়ে উঠেছেন তিনি। মমতা ব্যানার্জির পরিবারের অন্য কোনো সদস্যের মধ্যে কিন্তু দক্ষ রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠার লক্ষণ ছিল বলে আমার কখনোই মনে হয়নি,’ বলছিলেন রন্তিদেব সেনগুপ্ত।
সূত্র : বিবিসি
https://slotbet.online/